রিফাত নামের এক শিশুকে দেখলাম কনফিডেন্সের সাথে উত্তর দিচ্ছে। জাতীয় ফুলের নাম – ফুল। শিক্ষক বলছেন কী ফুল? সে আবারো গলার জোড় আরো এক স্কেল বাড়িয়ে বলছে – গাঙের ফুল।
আমি রিফাতের দীপ্তিময় চোখের দিকে তাকিয়ে ঘুরে এলাম আমার স্কুল জীবনে। এক শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করছে 'জাতীয় ফুলের নাম কি?
আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিয়েছিলাম – গোলাপ।
আমার শিক্ষক আমাকে মারেননি কিন্তু খুব হেসেছিলেন। বলেছিলেন পরের দিন যেন পড়া শিখে আসি।
এর কয়েক বছর পরে আমি আমার মেয়েকে স্কুলে দিলাম। সেও একদিন এই প্রশ্নের সম্মুখীন হলো।
আমার মেয়ে উত্তর দিয়েছিল 'গাঁদা ফুল। কারণ আমি তখন ফুলের বাগান করি। শীত আসলেই বাগান ভরে যেতো গাঁদাফুল দিয়ে। গোলাপও ফুটুতো। কিন্তু গোলাপ গাছে ছিল কাঁটা। সে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে গাঁদাফুল ছিড়তো, খেলতো। সবাইকে উপহার দিতো। আমি শেখানো সত্বেও সে তার প্রিয় ফুলের নামটিই শিক্ষককে বলল – এখানেই লেগে গেল গণ্ডগোল। শিক্ষক বিরক্ত হলেন। আমার কাছে চিঠি পাঠালেন, আমি যেন পরদিন স্কুলে আসি।
আমি মেয়েকে হাজারবার জিজ্ঞেস করেও কারণ বলতে পারলো না। আমি স্কুলে যেতেই শিক্ষক আমাকে জানালেন – আমার বাচ্চা ক্লাসে মনোযোগী না। সে নিয়মিত পড়া করে আসে না।
এবং আমি অভিভাবক হিসেবে অযোগ্য। কারণ আমি বাচ্চার খেয়াল রাখি না। আমি ভয়ে লজ্জায় থরথর করে কেঁপে উঠলাম। তারপর কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম – কোন প্রশ্নের উত্তর আমার মেয়ে দিতে পারেনি। জানার পরে অবাক হওয়া ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না।
সেদিন শুধু আমি না। আরো বেশ কয়েকজন মা বাবাকে টিচার ডেকেছিলেন। এবং তার প্রতিটি কারণ ছিল নিতান্ত তুচ্ছ।
এরপরে একদিন আমার মেয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। স্কুল কলেজের পরে ভার্সিটিতে যে আমার মেয়ের জন্য এমন অপমান লেখা আছে আমি জানতাম না। আমার মেয়ের একবার এসাইনমেন্ট তৈরি হলো না। বাড়িতে মেহমান পাশাপাশি তার অসুস্থতা। দুই মিলিয়ে সে দেরি করে ফেললো।
এক স্বনামধন্য শিক্ষক আমার মেয়ের সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা যে ' ভুল' এমনকি ভার্সিটিতে না এসে তার যে অশিক্ষিত থাকা উচিৎ ছিল জানাতে ভুললেন না।
আমার কথা কিন্তু কোন শিক্ষককে ছোট করার উদ্দেশ্যে না। আমি নিজেও পেয়েছি – আক্কাস স্যার, মিজানুর স্যার, অসীম স্যার, শিউলি আপা, ডেইজি আপা, রোকেয়া ম্যাডাম, রুখসানা ম্যাডামদের মতো শিক্ষক।
উনারা ক্লাসে পড়াতেন না পড়া হৃদয়ে গেঁথে দিতেন। উনারা ক্লাসে ঢুকতেন হাসতে হাসতে। যেন এইমাত্র কোন মজার কাণ্ড ঘটে গেছে। আর পেয়েছি 'মমতাজ ' আপাকে। তিনি যেন শুধু আমার শিক্ষকই ছিলেন না ছিলেন অভিভাবকও।
আজ রিফাতের বলার কনফিডেন্স দেখে আমি আবার আগের দিনে ফিরে গেছি। সেই শ্লেটে লেখার দিনে। যখন দুলে দুলে শিক্ষক যা বলতেন তাই আওড়াতাম। তখন যে সব ছড়া কবিতা, নামতা শিখেছি, আজও তা মূখস্ত আছে।
আমি ধন্যবাদ জানাই রিফাতের শিক্ষককে। উনি যখন রিফাতের মজার উত্তর শুনে বললেন – 'সব্বনাশটা কইরালচে। '
উনি শেখাচ্ছেন হাসিমুখে। না বকে, শাস্তি না দিয়ে, অপমান না করে। তাই অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা তাকে না জানিয়ে পারছি না। একদিন রিফাত হয়তো অনেক বড় হবে। তার বড় হওয়ার পেছনে সে হয়তো মনে করবে তার মাদ্রাসা বা স্কুলের শিক্ষকদের অবদান।
তাকরিমের মতো গোল্ড মেডেল নিয়ে স্যারের বাসায় যাবে। স্যারকে ডাকবে – স্যার, স্যার বাসায় আছেন?
- কে?
- আমি রিফাত।
- কোন রিফাত?
- জাতীয় ফুল গাঙের ফুল, বলা রিফাত।
- স্যার দেখেন আমি আপনার জন্য একটি উপহার এনেছি।
- তারপর সেই সোনার পদক বা মেডেলটি স্যারের হাতে তুলে দেবে।
- আমরা সেই সুন্দর দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।
- নিতু ইসলাম।